Thursday, April 3, 2014

ইউক্রেণ সংকট



হঠাৎ যেন দুনিয়াজুড়ে হইচই পড়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি পুটিনের নেতৃত্বে রাশিয়া তার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ইউক্রেণের ক্রিমিয়া প্রদেশে সামরিক অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তা কার্যত দখল করেছে বলে অভিযোগ পশ্চিমের সংবাদ-মাধ্যমে দিবারাত্রি পুটিনের গর্দান নেওয়ার দাবি জোরালো হয়ে উঠছে। সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রের চিন্তায় যাঁর রাতের ঘুম হয়না, সেই বারাক ওবামা তীব্রভাবে পুটিনের বিরুদ্ধে বয়ান দিয়েছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা লাগু করার হুমকি দিয়েছেন। একই সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার এহেন পদক্ষেপের কড়া ভাষায় নিন্দা করেছে। সব মিলিয়ে তাই যেন মনে হচ্ছে যে রাশিয়া হঠাৎ নতুন করে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠেছে। এবং শিশুরাও যেই দেশগুলিকে সাম্রাজ্যবাদী বলে জানে, সেই আমেরিকা ও ইউরোপ বিভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত হয়ে উঠেছেযেন তারা এই পৃথিবীতে কিছুতেই আর কোনরকম সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন সহ্যই করতে পারবেন না। আমেরিকার বিদেশ সচিব, জন কেরি, স্বমুখে বলেই ফেলেছেন যে একবিংশ শতাব্দতে উনবিংশ শতাব্দর মত যে কোন দেশ কে দখল করে নেওয়া যায়না।

এইসব দেখে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই। যেই আমেরিকা সারা পৃথিবীর সামনে অসত্য প্রচার করে ইরাকে হামলা চালিয়ে দেশটাকে ধ্বংস করে দিল, তারাই এখন আবার অন্য দেশকে সার্বভৌমত্ব নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছে। বছর দুই আগে আমেরিকার নেতৃত্বে লিবিয়ায় হামলা চালিয়ে সেই দেশের রাষ্ট্রপতি মুয়াম্মর গদ্দাফিকে হত্যা করে পশ্চিমের দেশগুলি। এই কয়েক মাস আগেই কেরি সাহেব প্রকাশ্যে হিসেব কছিলেন যে কিভাবে সিরিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে গদিচ্যূত করা যায়। বলে রাখা ভাল যে প্রত্যেকটি ঘটনাই ঘটে একবিংশ শতাব্দিতে, যখন কিনা কেরি সাহেবের মতে অন্য কোন দেশ আক্রমণ করা মহা অন্যায়। পৃথিবীর অবশ্য এই নিয়ম। ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের যেন অধিকার আছে যে কোন দেশ আক্রমণ করার। কিন্তু অন্য কেউ সেই একই কাজ করলে, ওয়াশিংটন, লন্ডন, ব্রাসেলস, পারিস থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো হয়, অবিলম্বে সামরিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। এবং বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে আমেরিকা ও তার সহযোগি রাষ্ট্রগুলির দ্বারা নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চললেই তুমি স্বাধীনতাকামী, নচেৎ, তুমি মানবতার শত্রু, গণতন্ত্র হত্যাকারী এক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র।

এই অবধি লিখে পরের পরিচ্ছেদে যাওয়ার আগেই দেখতে পাচ্ছি যে বড় বড় সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় লেখক ও মহা-পন্ডিতেরা প্রবল গাল পাড়ছেন এবং বলছেন যে আমি বা আমরা দ্বিচারিতার দায়ে দুষ্ট। আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করলে হইহই করে কলকাতার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে মিছিল সংগঠিত হয়। কিন্তু রাশিয়া যখন ছোট্ট ইউক্রেণের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে তখন আমরা নিশ্চুপ। অভিযোগটি গুরুতর। তাই একে খন্ডন করা আমি জরুরি বলে মনে করি। এবং বিনীতভাবে বলতে চাই যে এই সম্পাদকীয় লেখকগণ ও পন্ডিতেরা সাম্রাজ্যবাদ বিষয়টি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন।

প্রথমেই বলতে হবে যে রাশিয়ার ক্রিমিয়ায় সামরিক অনুপ্রবেশ আন্তর্জাতিক আইন স্বীকৃত নয়। ইউক্রেণ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই সেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু শুধু এইটুকু বললেই সবটা বলা হবে না। বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে হলে আরো গভীরে যেতে হবে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তনের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে ব্যাপক আকারে আয়ের সংকচন ঘটে। রাশিয়ার জিডিপি সোভিয়েত আমলের তুলনায় ৫০% হ্রাস পায় এক দশকের মধ্যে। ইউক্রেণও এই সমস্যার সম্মুখিন হয়। ১৯৯২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলির মধ্যে ইউক্রেণে মাথা পিছু প্রকৃত আয় বেড়েছে সবচেয়ে কমরাশিয়াতে যেখানে এই সময়কালে মাথা পিছু প্রকৃত আয় ১০০%’র বেশি বেড়েছে বা তুর্কেমেনিস্তানের মত দেশের ক্ষেত্রে বেড়েছে ৩০০%’র বেশি, সেখানে ইউক্রেণের বেড়েছে মাত্র ৫০% (তথ্য সূত্র: ইকনমিস্ট পত্রিকার ওয়েবসাইট, Why is Ukraine’s Economy in Such a Mess)নব-উদারবাদী পুঁজিবাদের তত্ত্ব মেনে ইউক্রেণ অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে এগোয় ও আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি কে আমন্ত্রণ জানায় মুক্ত হস্তে। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি যাতে দেশে এসে বেশি মুনাফা কামাতে পারে তার জন্য দেশে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সংকটের ঝড় এসে ধাক্কা মারে ইউক্রেণের অর্থনীতিকে। ইউরোপ ও আমেরিকার যেইসব আর্থিক সংস্থা এই দেশে লগ্নি করেছিলেন তারা টাকা ফেরত চান। অন্যদিকে নতুন লগ্নিও আর ইউক্রেণে আসে না। ফলত, দুমুখ সমস্যার সম্মুখিন হয় এই দেশ। প্রথমত, ইউক্রেণে মন্দা দেখা দেয়—২০০৯ সালে ইউক্রেণের জিডিপি ১৫% হ্রাস পায়। দ্বিতীয়ত, বিদেশি পুঁজি ইউক্রেণে আর প্রবেশ না করার ফলে এবং বেরিয়ে যাওয়ার ফলে, ইউক্রেণের বৈদেশিক মূদ্রার ভান্ডার ২০১১ সালের ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে বর্তমানে নেমে এসেছে মাত্র ১২ বিলিয়ন ডলারে। এহেন অবস্থায় আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার ইউক্রেণকে ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়। কিন্তু শর্ত থাকে যে ব্যাপকভাবে ভর্তুকি কমাতে হবে। কিন্তু ইউক্রেণের সরকার তাতে রাজি না হওয়াতে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার সেই ঋণ দিতে অস্বীকার করে। 

এহেন অবস্থায় ইউক্রেণের শাসককুল দেশের সংকট নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলেন এমন দাবি করা যাবেনা। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত বাকি দেশগুলির মতই ইউক্রেণেও রাজনীতিবিদেরা জনগণের সেবার থেকে অনেক বেশি করে মনযোগ দেন নিজেদের আখের গোছাতে। ফলত, দুর্নীতির ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় দেশের অর্থনীতি ও সমাজ। এমতাবস্থায় ২০১০ সালে ক্ষমতায় আসেন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। আগের এক দশকের তীব্র দুর্নীতি ও অপশাসনের ফলে তিনি জয় লাভ করেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তিনি তাঁর বিরোধী নেত্রীকে জেলে পাঠান। নতুন সরকারের আমলেও দুর্নীতি অব্যাহত থাকে। কিন্তু বিশ্ব আর্থিক সংকটের ঢেউ ইউক্রেণে এসে ধাক্কা দেওয়ার ফলে ইউক্রেণে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় তার মোকাবিলা কিভাবে করা সম্ভব তা নিয়ে দেশের সরকারকে মাথা ঘামাতে হয়।

এই প্রশ্নে দুটি পথ তাদের সামনে দেখা দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফ থেকে তাদের কে একটি বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সেই চুক্তিতে বিভিন্ন প্রকারের শর্ত আরোপ করা হয় যা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। অপরদিকে রাশিয়া ইউক্রেণকে ১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, বিনা শর্তে। এহেন অবস্থায় ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাব নাকচ করেন। নভেম্বর ২০১৩ তে ইয়ানুকোভিচের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কিয়েভ শহরের ‘ময়দান’এ প্রতিবাদ শুরু হয়। জানুয়ারি মাসে পুলিশের সাথে সঙ্ঘর্ষে মারা যান তিন জন। এরপরে প্রতিবাদ আরো তীব্র হয়। মাঠে নামেন আমেরিকার সাংসদ, বিগত নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জন ম্যাকেন। তিনি কিয়েভের ময়দানে গিয়ে আন্দোলনকারী মানুষদের অভিনন্দন জানান। অন্যদিকে উগ্র দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদি দল, যেমন Svoboda বা প্রাইভি সেক্টর আন্দোলনের রাশ নিজেদের দিকে টেনে নেয়। ইয়ানুকোভিচ বাড়তে থাকা চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন—তাঁর নিজের ক্ষমতা হ্রাস করা ও সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার দাবি তিনি মেনে নেন, ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেন এবং পুলিশকে কিয়েভের রাস্তা থেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু এই সমস্ত ঘোষণার পরে এবং পুলিশ রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে ফ্যাসিবাদি খুনিদের দল মানুষের উপরে গুলি বর্ষণ করেন, কিয়েভ শহরের দখল নেন এবং ইয়ানুকোভিচকে সরিয়ে দেশের স্পিকারকে রাষ্ট্রপতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান।

এই ঘটনা পরম্পরার প্রেক্ষাপটে কয়েকটি গুরুতর প্রশ্নের অবতারণা করতে হবে। প্রথমত, ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে যত বড় আন্দোলনই হয়ে থাকুক না কেন, তাঁকে যেভাবে অপসারিত করা হল, তা কী ইউক্রেণের সংবিধান সম্মত? এক কথায় উত্তরটি হল: নারাষ্ট্রপতির অপসারণ কিভাবে করা যেতে পারে তা ইউক্রেণের সংবিধানে খুব স্পষ্টভাবে বলা আছে। যেমন, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে তদন্ত করে তার রিপোর্ট সংসদে পেশ করার কথা বলা আছে সংবিধানে। সেসব কিছু করা হয়নি। সংবিধান বিরুদ্ধভাবে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে দেওয়া হল কিছু উগ্র-ফ্যাসিবাদি সংগঠনের মাধ্যমে, এবং আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকে মান্যতা দিল। এর কারণ কি তা অনুধাবন করতে বিশেষ সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মূলত, রাশিয়াকে আরো কোনঠাসা করার জন্য ইউক্রেণে তাঁদের বশংবদ কোন ব্যক্তিকে গদিতে বসানো ছিল আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের লক্ষ্য। মাননীয়, সম্পাদকীয় লেখক ও পন্ডিতেরা কী এহেন অসাংবিধানিক পদ্ধতি ও তার প্রতি আমেরিকা ও ইউরোপের সমর্থন কে সঠিক বলে মনে করেন?

দ্বিতীয়ত, ইউক্রেণ হঠাৎ আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের কে একবার তাকাতে হবে ইউক্রেণ ও রাশিয়ার মানচিত্রের দিকে। ইউক্রেণের পশ্চিমে পোলান্ড ও রোমানিয়া এবং পূ্র্বে রাশিয়া, উত্তরে বেলারুশ ও রাশিয়া এবং দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর।

বিগত বেশ কিছু বছর ধরে আমেরিকা চাইছে যে ন্যাটো’কে রাশিয়ার যতটা সম্ভব নিকটে বিস্তৃত করতে। রাশিয়াকে কোনঠাসা করার জন্য বহুবার আমেরিকা বিবিধ উপায়ে ন্যাটোকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছে অথবা মিসাইল ডিফেন্স শিল্ডের নামে রাশিয়ার দিকে মিশাইলের নিশানা তাক করেছে বর্তমানে প‌োলান্ড ও রোমানিয়া দুটি দেশই ন্যাটোর সদস্য।  ইউক্রেণে যদি একটি বশংবদ সরকার বসিয়ে তাকে বাধ্য করা যায় ন্যাটোর সদস্য হতে তবে আমেরিকা ও তার মিত্রেরা রাশিয়ার ঘাড়ে এসে পড়বে। ১৯৯০ সাল থেকে লাগাতার ইউক্রেণের মানুষ ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন কিন্তু দেশের শাসক শ্রেণি ন্যাটো’র সাথে যৌথ সামরিক মহড়া করেছে, ইরাকে ও আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়েছে। ইয়ানুকোভিচের অনেক সমস্যা থাকলেও তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি ন্যাটোর অংশ হতে রাজি হননি। ন্যাটোকে বিস্তার করার জন্য ইয়ানুকোভিচের সরকারের সরে যাওয়াটা তাই একান্তই দরকার। গণতন্ত্র বা মানবতা নয়, বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় রাশিয়াকে বাজিমাত করার জন্যই হঠাৎ সব পশ্চিমি দেশগুলি ইউক্রেণ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

তৃতীয়ত, ইউক্রেণের মানুষ কি বলছেন? এই প্রশ্নটির উত্তর খুব জটিল। ইউক্রেণ একটি বহু-জাতীয়, বহু-ভাষা ও বহু ধর্মের মানুষের দেশ২০০১ সালের হিসেব অনুযায়ী, ইউক্রেণে ৭৭.৮% ইউক্রেণীয় ও ১৭.৩% রুশ জনগোষ্ঠীর মানুষ থাকেন। আবার ৬৭% মানুষের ভাষা ইউক্রেণীয় আর ২৪% মানুষের ভাষা রুশ (তথ্য সূত্র: Wikipedia The World Fact Book, CIA)এদের মধ্যে ইউক্রেণীয় সম্প্রদায়ের মানুষ মূলত থাকেন পশ্চিম প্রান্তে এবং রুশ সম্প্রদায়ের মানুষ থাকেন পূ্র্ব প্রান্তে। ইয়ানুকোভিচ কে অপসারণ করে যেই সরকার ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরা প্রথমেই সরকারী কাজে রুশ ভাষা ব্যবহার কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং কমিউনিস্ট পার্টি (যারা বিগত নির্বাচনে ১৩% ভোট পেয়েছিল) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এই ধরণের পদক্ষেপ স্বাভাবিক ভাবেই একটি বহু-জাতীয় দেশের সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করেছে। ইউক্রেণের পূর্ব প্রান্তের বাসিন্দারা মনে করছেন যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন। ফলত, তাঁরা রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছেন। আবার পশ্চিম প্রান্তের বাসিন্দারা রাশিয়া ও রুশ মানুষদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শান দিচ্ছেন ও আমেরিকা বা ইউরোপের দিকে ঝুঁকছেন। এক কথায় বলা যায় যে ইউক্রেণের মত বহু-জাতীয় দেশের সামাজিক সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। অতীতে আমরা দেখেছি যে যেখানে যেখানে আমেরিকা বা ন্যাটো হস্তক্ষেপ করেছে সেখানেই এই সমস্যা দেখা গেছে। ইরাকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি শিয়া ও সুন্নির লড়াই, লিবিয়াতে আমরা প্রত্যক্ষ করছি বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে লড়াই, সিরিয়াতেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এই লড়াই। এখন সেই লড়াই শুরু হয়েছে ইউক্রেণে।

চতুর্থত, এবং বর্তমানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, রাশিয়ার যে ভূমিকা তাকে আমরা কি ভাবে পর্যালোচনা করব। আমরা আগেই বলেছি যে রাশিয়াকে ঘিরে ধরার নীতি ওয়াশিংটন বহুদিন থেকেই নিয়েছে, যার মূল উপাদান হলো ন্যাটো কে বিস্তৃত করার নীতি। রাশিয়ার দিক থেকে আমরা যদি দেখি তাহলে দেখব যে ইউক্রেণের ক্রিমিয়া প্রদেশ রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিমিয়া আসলে একটি স্ব-শাসিত প্রদেশ যার নিজস্ব সংসদ রয়েছেক্রিমিয়াতে ২০০১ সালের হিসেব অনুযায়ী ৫৮.৩২% রুশ ও ২৪.৩২% ইউক্রেণীয় জাতীয় মানুষ বসবাস করেন। ফলত, কিয়েভের অভুত্থান ও রুশ ভাষা নিষিদ্ধ ঘোষণা করার বিরূপ প্রক্রিয়া এসে পড়ে এই অঞ্চলে‌। অন্যদিকে, রাশিয়ার নৌবাহিনীর কৃষ্ণ সাগরের নৌবহর (Black Sea fleet) ক্রিমিয়ার সেভাস্তপোল শহরে অবস্থিত, ইউক্রেণের সাথে চুক্তির মাধ্যমে। ফলত, একদিকে যদি ইউক্রেণের সরকার আমেরিকাপন্থী হয়ে যায় ও ন্যাটোর সদস্যপদ গ্রহণ করে তবে আমেরিকা রাশিয়ার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলবে; অন্যদিকে, রাশিয়ার নৌবহরের অবস্থান’ও অনিশ্চিত হয়ে যাবে। তাই রাশিয়ার পক্ষে এমন কোন ব্যবস্থা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, যেখানে তার প্রভাবের বাইরে চলে যাবে ইউক্রেণ। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাধ্য-বাধকতার চাপেই রাশিয়া কে সেনা পাঠাতে হয়েছে ক্রিমিয়ায় এবং ক্রিমিয়া’র সংসদ আর ইউক্রেণের অংশ হিসেবে থাকতে রাজি নয় বলে প্রস্তাব পাশ করেছে। আমরা আগেই বলেছি যে রাশিয়া’র পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। কিন্তু আমরা তার সাথে এও মনে করি যে ইউক্রেণের নির্বাচিত সরকারকে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক উপায়ে সরানো হয়েছে, আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমি দেশের মদতে। এই সমস্ত পদক্ষেপ ও প্ররোচনাকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র রাশিয়া’র সেনা পাঠানো কে অন্যায় আখ্যা দিলে সত্যের অপলাপ হবে।

উপরোক্ত সমস্ত ঘটনাবলী ও তার বিশ্লেষণের উপরে ভিত্তি করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রথমত, রাশিয়া কে ইউরোপ তথা আমেরিকা যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা লাগু করার হুমকি দিচ্ছে তা অনেকটাই ফাকা আওয়াজ। কারণ, ইউরোপের ৩০%’র বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে স্বল্প মূল্যে। ইউরোপ কে যদি সেই গ্যাস অন্য কোন দেশ থেকে কিনতে হয় তবে তা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ হবেআর্থিক সংকটে আক্রান্ত ইউরোপ এখন এই ধরণের অতিরিক্ত খরচের ধাক্কা সামলাতে পারবে না। ফলত, তারা রাশিয়াকে যেমন চাপে রাখার চেষ্টা করছে, তেমনি রাশিয়াও জানে যে রাশিয়া কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে ইউরোপেরও মুশকিল আছে। দ্বিতীয়ত, পুটিনের নেতৃত্বে রাশিয়া নতুন করে বিশ্ব-রাজনীতির আঙিনায় তার দড় বাড়াতে চায় ও হস্তক্ষেপ করতে চায়। আমেরিকা’র বিভিন্ন রণনীতি সংক্রান্ত দলিল পড়লেই জানা যায় যে তারা পৃথিবীতে তাঁদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী কে খাড়া হতেই দেবেন না বলে বদ্ধ পরিকর। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে রাশিয়া’র আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে উত্থান আমেরিকার সহ্য না হওয়ারই কথা।

কিন্তু বারবার দেখা যাচ্ছে যে আমেরিকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ছক ভেস্তে দিচ্ছেন পুটিন। যেমন, বিগত বছরে দেখা গেল যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি সিরিয়া কে আক্রমণ করবেন বলেও আর করে উঠতে পারলেন না কারণ রাশিয়া তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এই ক্ষেত্রেও দেখা গেল যে আমেরিকা বারবার বারণ করা সত্ত্বেও রাশিয়া তার মর্জি মত ইউক্রেণের প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করছেন। তাহলে কী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রথের চাকা থমকে গেল? কিছুটা তো থমকে গেল বটেই। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসাবশেষের উপরে দাঁড়িয়ে আমেরিকা খাড়া করেছিল ‘এক মেরু’ ভিত্তিক পৃথিবী। বেশ কিছু বছর পৃথিবীতে আমেরিকা যা মনে করেছে তাই করেছে—ইরাক ও আফগানিস্তানে আক্রমণ , দক্ষিণ আমেরিকায় বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কিন্তু এখন অবস্থা একটু পালটিয়েছে। চীন, রাশিয়ার মত দেশগুলিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। এই দেশগুলির শাসক শ্রেণি বা বুর্জোয়ারা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের কর্তৃত্ব অনেকাংশেই উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির হাতে থাকলেও মাঝে মধ্যে তাদের সাথে সংঘাত বাধছে চীন বা রাশিয়ার। সেই সময়ে তারা তাদের জাতীয় শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে কখনও কখনও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করছেন। ইউক্রেণের প্রশ্নে রাশিয়া ও পশ্চিমি দেশগুলির মধ্যেকার সংঘাত কে খুব সহজেই এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান চীন বা রাশিয়া বা BRICS অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির এই অবস্থানের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানের পার্থক্য করা জরুরি। সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র একটি বিকল্প সমাজব্যবস্থার উপরে ভিত্তি করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করত। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে এই দেশগুলির যে দ্বন্দ্ব আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা কোন বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলেনা। বরং আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের মধ্যে স্ব-স্ব দেশগুলি নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে তারা ব্যস্ত। সেই লড়াই’এ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির সাথে কখনও কখনও তাদের মধ্যে সংঘাত ঘটছে যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। তাই মনে রাখতে হবে যে পুটিন কোন বিপ্লবী নন। কিন্তু এই সংঘাত কখনও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সামনে একটি আলোর রেখা দেখায়—যেমন সিরিয়া। আবার এই দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে দুর্বল দেশ—যেমনটা হচ্ছে ইউক্রেণে।

(লেখাটি আরেক রকম পত্রিকার ১ এপ্রিল-১৫ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত। কিন্তু প্রবন্ধটি লেখার সময়, রাশিয়ায় যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে ক্রিমিয়ার গণভোট হয়নি)





Wednesday, March 5, 2014

ঝুম্পা লাহিড়ি’র উপন্যাস ‘The Lowland’: একটি রাজনৈতিক পাঠ

আমরা তিন ভাই বড় হয়েছি টালি-নালার গায়ে লাগানো এক উদ্বাস্তু কলোনীতে। তাই যখন জানতে পারলাম যে স্বনামধন্য লেখিকা ঝুম্পা লাহিড়ি সেই টালিগঞ্জ পাড়ার পটভূমিকায় দুই ভাইয়ের গল্প নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছেন, তখন তা না পড়ে থাকতে পারলাম না।

উপন্যাসটি শুরু দুই ভাইকে কেন্দ্র করে—সুভাষ ও উদয়ন। স্বাধীনতা পরবর্তী কলকাতায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তারা বড় হয়েছে, একে পরের প্রতি প্রবল ভালবাসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ায়। কিন্তু চরিত্রগত দিক থেকে তাদের মধ্যেকার পার্থক্য অনেক ছোটবেলা থেকেই প্রকট হতে থাকে। সুভাষ ধীর স্থির। কিন্তু উদয়ন দামাল এবং নিজের ইচ্ছে কে জোর করে প্রতিষ্ঠা করাই তার স্বভাব। তৎকালীন সময়ের রাজনীতির আঁচ এসে পড়ে তাদের ছোট বাড়িটিতে। একদিকে কিউবা’র বিপ্লব, ফ্রান্সের ছাত্র বিদ্রোহ এবং সর্বপরি ভিয়েতনাম। আর ঘরের কাছে বাড়তে থাকা বামপন্থী আন্দোলন ও নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান। এই সমস্ত ঘটনাগুলি উদয়নকে প্রবল নাড়া দেয়। সুভাষকে এই রাজনৈতিক ডামাডোল খুব বেশি প্রভাবিত করে না। সে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে চলে যায় মার্কিন দেশে। কিন্তু উদয়ন জড়িয়ে পড়ে নকশাল আন্দোলনে। হয়ে ওঠে তাঁদের একজন সৈনিক।

উদয়ন নকশাল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ার পরে গৌরী নামে এক কলেজ ছাত্রীর প্রেমে পড়ে এবং শীঘ্রই তাদের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু সেই বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একদিন সন্ধ্যেবেলা পুলিশ আসে। উদয়ন লুকিয়ে থাকলেও সে ধরা পড়ে। তার বাবা-মা-স্ত্রীর সামনে তাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এটিই আলোচ্য উপন্যাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যাকে কেন্দ্র করে বাকি উপন্যাসটি আবর্তিত হয়। ‌

উদয়নের মৃত্যু তার পরিবারকে তছনছ করে দেয়। একদিকে তার প্রৌঢ় বাবা-মা শোকে পাথর হয়ে যান। অন্যদিকে গৌরীর প্রতি তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েনসুভাষ ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে দেশে ফিরে জানতে পারে যে গৌরী সন্তান-সম্ভবা। তার বাবা-মায়ের গৌরীর প্রতি ব্যবহার সুভাষকে ব্যথিত করে এবং সে গৌরীকে বিয়ে করে নিয়ে যায় আমেরিকাতে। কিন্তু গৌরী মন সে পায়না। ক্রমাগত গৌরী তার নিজের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে থাকে। সংসার সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ উদাসীন। এবং যখন উদয়নের মেয়ে বেলা’র জন্ম হয় তখনও দেখা যায় যে গৌরী তার সম্পর্কেও উদাসীন। শেষ অবধি সে সুভাষ ও বেলা কে পরিত্যাগ করে দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী নিয়ে চলে যায়। এরপরে এই তিনজনের জীবন একই রকম একাকীত্বের মধ্যেই অতিবাহিত হয়।

উপন্যাসটির শুরুতে ১৯৬০-৭০ দশকের কলকাতা ও তার রাজনীতির কথা খুব সুন্দরভাবে এসেছে। মনে হয়েছিল নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতা বা সাফল্য, তার রাজনীতি, তার আদর্শ ইত্যাদি নিয়ে লেখিকা আলোচনা করবেন। কিন্তু উপন্যাসটি সেই পথে এগলো না। রাজনীতি, বিশেষ করে বাম রাজনীতি (তা যেই ধারারই হোক না কেন) তার মধ্যে সমষ্টির একটি প্রবল স্থান আছে। সমষ্টির স্বার্থ বাম রাজনীতির মূল কথা। শ্রেণিগত বৈষম্য, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদির বিরুদ্ধেই বামপন্থীদের প্রতিবাদ, আন্দোলন। উদয়ন এই সমষ্টির সাথে নিজেকে মিলিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। তার পথ ভুল ছিল তা ইতিহাস প্রমাণ করেছে। কিন্তু তার মধ্যে সমষ্টির প্রতি প্রবল দায়বদ্ধতা ছিল। কিন্তু লেখিকা উদয়নের বাইরে গিয়ে কখনও সেই সমষ্টিকে ধরার চেষ্টা করেননি। যতটা দেখা গেছে তা উদয়নের তারুণ্যের রোমান্টিকতার চোখ দিয়ে, লেখিকার চোখ দিয়ে নয়।

তাই উদয়নের মৃত্যুর সাথে সাথে উপন্যাস থেকে বিদায় নেয় রাজনীতি ও সমষ্টিমুখ্য চরিত্ররা চলে যায় আমেরিকাতে। সেখানেও তারা কোন সমষ্টির অংশ নয়। তাদের সমষ্টিগত কোন দায়বদ্ধতা বা চিন্তা ভাবনা দেখা যায়না। তারা ব্যস্ত তাদের ব্যক্তি সত্ত্বার সংকটগুলি কে সমাধান করতে। শুধু তাই নয়উদয়নের মৃত্যুর পরে গৌরীর নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, তার দুঃখ, তার বেদনা সবই লেখিকা খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। অনেক সময়ে পাঠকের মনে উদয়নের থেকেও হয়ত বেশি মাত্রায় গৌরীর প্রতি সহানুভূতি জেগে ওঠে। লেখিকা যেন পাঠক কে ভাবতে বাধ্য করন যে উদয়ন এই সব রাজনীতি না করলে গৌরীর জীবনে এত দুঃখ নেমে আসত না। উদয়নের মৃত্যুর জন্য লেখিকা যেন রাষ্ট্রের হত্যার বাইরে গিয়ে উদয়নের রাজনীতিকেই দোষারোপ করছেন।

উদয়ন ও সুভাষ দুই ভাই হলেও তাদের চারিত্রিক ফারাক ছিল। উদয়ন রাজনীতিতে উৎসাহী, একজন সক্রিয় কর্মী। সুভাষ তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। দেশ ছেড়ে সে চলে এসেছে আমেরিকাতেশুধু তাই নয়। সুভাষকে যেন লেখিকা গড়ে তুলেছেন মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত রূপে। তার প্রয়াত ভাইয়ের স্ত্রী কে সে বিয়ে করে, তার কন্যা কে সে নিজের কন্যার মত মানুষ করে, গৌরী সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও সে গৌরীকে দোষারোপ করে না, গৌরীর কথা মেনে সে গৌরীর সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না, মেয়ের প্রতি তার ভালবাসা সে উজাড় করে দেয়। সুভাষের মধ্যে লেখিকা যেন একজন আদর্শ পুরুষের মূর্তি তৈরী করেছেন। কিন্তু সুভাষ সম্পূর্ণভাবে একজন অরাজনৈতিক মানুষ। তার ভাইয়ের মৃত্যু তাকে দুঃখী করে, শোক করে সে। কিন্তু তৎকালীন কলকাতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সে কোন রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে না। এমনকী ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী পুলিশদের শাস্তির জন্য বা আরো অনেক উদয়নের জন্য সে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে না। সে তার দায়িত্ব পালন করে ঘরের সীমা রেখার মধ্যে।  পারিবারিক গন্ডির মধ্যে সুভাষের এই আদর্শ পুরুষের রূপের সাথে উদয়নের চারিত্রিক বৈশিষ্ট, তার বেহিসেবি জীবনযাপন ইত্যাদি লেখিকা পাঠকের সামনে প্রকট করে তুলেছেন। উদয়ন চলতি ভাষায় ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছে’। সে তার স্ত্রী, কন্যা, বাবা-মা, ভাই কারোর প্রতিই সঠিক দায়িত্ব পালন করেনি। বাইরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে তার অপমৃত্যু হয়েছে। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে তার স্ত্রী ও বাবা-মাকে। আবার যেন লেখিকা আমাদের উদয়নের রাজনীতি শুধু নয়, সমগ্র সমষ্টিগত রাজনীতির নিষ্ফলতা, শূন্যতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।

সমাজ বদলের রাজনীতি যুব সমাজ সব সময় করেছে এবং এখনও করছে। কিন্তু এই রাজনীতির ঝুঁকি আছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে ব্যক্তিগত জীবনে আত্মত্যাগ করতে হবে, হয়ত কিছু প্রাণও দিতে হবেকারণ রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামনে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করবে নাএই রাজনৈতিক যুদ্ধে শহীদ হলে একথা অনঃস্বীকার্য যে তার পরিবারের উপর নেমে আসবে শোক, অবসাদ ও অন্যান্য সমস্যা। কিন্তু সেই সব সমস্যার ভয়ে দিন বদলের রাজনীতি করা যাবে না, এই কথা যদি সবাই ভেবে বসে তবে ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের গরীব মানুষ রোজ ভ্রাতৃবিয়োগ, পুত্রবিয়োগ বা স্বামীবিয়োগের যন্ত্রণাভোগ করছেন। দেশের অধিকাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার, অধিকাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভোগেন। তাই অনেক মায়ের কোল অকালেই খালি হয়ে যায় অহরহ। দেশে আড়াই লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। তাদেরও পরিবার পরিজন ছিল। তাদের প্রিয়জন হারানোর দুঃখ গৌরী, সুভাষ বা বেলার থেকে কিছু অংশে কম নয়। কিন্তু সেই স্বজন হারানো গরীব মানুষগুলি এই উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠেননি—নকশাল আন্দোলনে শহীদের পরিবারের দুঃখ একাকীত্ব হয়ে উঠেছে উপন্যাসের মূল বিষয়।

অনেকে বলতে পারেন যে লেখিকা নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি লিখেছেন। এটি সার্বিকভাবে রাজনীতির সমস্যা নিয়ে লেখা নয়। তাই উপন্যাসটিতে নকশাল আন্দোলনের সমালোচনা করা হয়েছে বলা যেতে পারে। এই উপন্যাসের মূল সুরটি সার্বিক রাজনীতির বিরুদ্ধে নয়। এই যুক্তিটি দুটি কারণে ভুলপ্রথমত, আগেই বলা হয়েছে যে নকশাল আন্দোলন নিয়ে কোন গভীর আলোচনা লেখিকা করেননি। আন্দোলনটি নকশাল আন্দোলন না হয়ে অন্য যে কোন আন্দোলন হলেও উপন্যাসের মূল বিষয়ে কোন ফারাক হত বলে মনে হয়না। শুধু দরকার ছিল একজন রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু এবং তার দরুন তাঁর পরিবারের গভীর শোক ও এককীত্বদ্বিতীয়ত, নকশাল আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার বুকে প্রথম এবং শেষ আন্দোলন ছিল না। তার পরেও এ রাজ্যে জমির প্রশ্নে, শিক্ষার প্রশ্নে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমরা সুবৃহৎ বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু উপন্যাসে সে সবের খুব বেশি উল্লেখ নেই কারণ পাত্র-পাত্রীরা সব আমেরিকাতে চলে গেছেন উদয়নের মৃত্যুর পরে। তাই এই আন্দোলনগুলির সাথে নকশাল আন্দোলনের সফলতা, ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে কোন তুলনামূলক মূল্যায়ন করার চেষ্টা উপন্যাসে দেখা যায়নি। নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থতার পরে যে নৈরাশ্য যুব সমাজের একাংশের মধ্যে জেগেছিল, সেই নৈরাশ্যের অন্ধকার ভেদ করে লেখিকা কোন আশার আলোর কথা বলেননি। লেখিকা যেন একটি dystopia তৈরী করছেন যার জন্ম রাজনৈতিক আন্দোলনেরই আঁতুড় ঘরে।

সব মিলিয়ে তাই বলা যেতে পারে যে সক্রিয় বাম রাজনীতি যে utopia কে বাস্তবায়িত করার কথা বলে উপন্যাসটি সেই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে এক dystopia’র কল্পনা করছে। সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তি মানুষের ক্ষতি হলে তার দায়ভার এসে পড়ে তার পরিবারের উপর। সেই পরিবারটির সমস্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন ধ্বংস হয়ে যায়। মুক্তির সন্ধানে নিমগ্ন উদয়নের রাজনীতি তাঁর পরিবারের জন্য জন্ম দেয় এক বিভিষীকার।

আসলে dystopia’র এই ভাবনা মনে হয় বর্তমান পৃথিবীর সমস্যা, তার রাজনীতির এক বিমূর্ত অভিব্যক্তি। আজ পৃথিবী এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটে নিমগ্ন। সারা পৃথিবী জুড়ে গত কয়েক বছরে উথালপাথাল করা রাজনৈতিক আন্দোলন ঘটে গেছে—অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট, আরব বসন্ত ইত্যাদি। কিন্তু এই আন্দেলনগুলি শুরুতে মানুষের মনে প্রত্যাশার জন্ম দিলেও, অকালে শুকিয়ে গেছে, কোন প্রকৃত বিকল্প সমাজব্যবস্থার ভিত নির্মাণ না করে। এই আন্দোলনগুলি মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলিকে রাজনীতির মূল প্রশ্নে রূপান্তর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু তবু যেই ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থাগুলি ২০০৮’র সংকটের জন্য দায়ী, তারা আবার ফুলে ফেঁপে উঠেছে ও অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করছে; মিশরে মুবারকের মত একনায়ক কে গদিচ্যুত করা হল, কিন্তু আবার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। ফলত, এই আন্দোলনগুলি অনেকাংশেই তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। নকশাল আন্দোলন এমন এক সময়ে সংগঠিত হয়েছিল যখন সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের মর্যাদা ছিল অপরিসীম। আজ সমাজতন্ত্র পিছু হটেছে। নতুন দুনিয়া নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের সন্ধান করছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের আন্দোলনগুলির ব্যর্থতা অনেকের মনেই নিরাশার জন্ম দিয়েছে। সেই নিরাশার জন্মদাগ বহন করছে উপন্যাসটি আজকের সময়ের এই নিরাশা তাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের নিরাশার মাধ্যমে।


রাজনৈতিক নিরাশা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের বিলাস হতে পারে। কিন্তু গরিব খেটে খাওয়া মানুষের কাছে রাজনীতি ব্যতিরেকে তার জীবনের উন্নতি সম্ভব নয়। তারা রাজনৈতিক ভাবে নিরাশায় ডুবে যেতে পারেন না। তারা তাই সন্ধান করে চলেছেন নতুন রাজনীতির, সাবেকি সমাজতন্ত্রের পতনের পরে নতুন পরিস্থিতিতে মানানসই রাজনৈতিক তত্ত্বের তালাশ। সেই তালাশ কোন ব্যক্তির তালাশ নয়। সমষ্টিগত আন্দোলনের মাধ্যমেই সেই জায়গায় পৌঁছতে হবে। এই আশায় ভর করে নতুন রাজনীতি, নতুন বিশ্ব নিয়ে রচিত হবে উপন্যাস। তবে তা আমেরিকায় বসে ঝুম্পা লাহিড়ি হয়ত লিখবেন না। লিখবেন সেই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসা নতুন লেখিকা।